প্রাচীন বিশ্বে ভূতের ভাবনা

সংজ্ঞা

Joshua J. Mark
দ্বারা অনুবাদ করা হয়েছে, Pratim Das দ্বারা অনুবাদ করা হয়েছে
30 October 2014 এ প্রকাশিত
Roman Skull with Obol in Mouth (by Falconaumanni, CC BY-SA)
মুখে ওবল সহ রোমান করোটি
Falconaumanni (CC BY-SA)

পরকাল আছে, এই বিশ্বাস প্রাচীন বিশ্বের প্রতিটি প্রধান সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এবং এই বিশ্বাসই মৃত মানুষের আত্মাকে ভূত হিসাবে বাস্তবতার স্বীকৃতি দিতে উত্সাহিত করেছিল। যারা কোনও না কোনও কারণে, হয় মৃতের রাজ্য থেকে ফিরে এসেছিল বা জীবিতদের জগত থেকে চলে যেতে অস্বীকার করেছিল।

প্রাচীন বিশ্বের মানুষের কাছে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহই ছিল না যে একজন মানুষের আত্মা শারীরিকভাবে মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকত। এই বিষয়ে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক না কেন, সাংস্কৃতিকভাবে তাদের এই ভাবনার দ্বারা জারিত বা লালনপালন করা হত যে, মৃত মানুষেরা অন্য এক রূপে বেঁচে থাকে। যার জন্য জীবিত থাকার পরেও কিছু বিশেষ ধরণের ভরণ-পোষণের প্রয়োজন আছে। এই মৃত্যু পরবর্তী জীবন বিভিন্ন কারণের সূত্রে নির্ধারিত হয়েছিল। যেখানে মূল ভাবনা ছিল, পৃথিবীতে বসবাস করার সময় মৃত ব্যক্তি কী ধরণের জীবনযাপন করত, কীভাবে তার মৃতদেহর সৎকার করা হয়েছিল এবং জীবিতরা কীভাবে তাদের মনে রেখেছে।

বিভিন্ন সংস্কৃতিতে পরকালের বিশদ বিবরণ ভিন্ন ভিন্ন রকমের, কিন্তু একটা বিষয় এক - এমন এক রাজ্য বিদ্যমান ছিল, যা এক অপরিবর্তনীয় আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেটা হলো মৃতদের আত্মা সেখানেই থাকবে যদি না বিশেষ কোনও কারণে জীবিতদের দেশে ফিরে যাওয়ার ‘লাইসেন্স’ বা অনুমতি দেওয়া হয়। এই কারণগুলির মধ্যে আছে - অনুপযুক্ত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, ঠিকঠাক নিয়ম না মেনে কবরস্থ করা, জলে ডুবে মৃত্যু যেখানে মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়নি, এমন হত্যা যেখানে মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি (এবং তাই সঠিকভাবে কবর দেওয়া হয়নি), বা জীবিত থাকা অবস্থায় থেকে যাওয়া কিছু অসমাপ্ত কাজ শেষ করার ইচ্ছে, কারও মৃত্যুর আসল ঘটনা বা কারণ জানানো। কেউ হয়ত খুন হয়েছিল বা তাকে হত্যা করা হয়েছিল, তার প্রতিশোধ নেওয়ার প্রয়োজন আছে। শান্তিতে বিশ্রামের জন্য হত্যাকারীকে বিচারের মুখোমুখি করা দরকার।

মরে যাওয়া মানুষের ভূতের আবির্ভাভাব তা সে যত প্রিয়জনের হোক না কেন, খুব কম ক্ষেত্রেই ভালো একটা অভিজ্ঞতা হিসাবে বিবেচিত হয় বা হতো। মৃতদের তাদের জন্য নির্দিষ্ট জগতেই থাকার কথা, জীবিতদের জগতে তারা ফিরে আসুক এটা কেউ আশা করে না। যখন এরকম কোনও ঘটনা ঘটত তখন ধরে নেওয়াই হতো, এটা নিশ্চিত ভাবেই একটা সংকেত যে, কিছু একটা সাংঘাতিক ভুল হয়েছে। যারা এরকম কোনও কিছুর দেখা পেত তারা সেই ভুল বা সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করত এবং প্রত্যাশা করত যে, ভূতটা তার সঠিক জায়গায় ফিরে যাবে।

এই বোঝাপড়াটা এতটাই প্রচলিত ছিল যে, এই একই ধরণের ভূতের গল্প একাধিক প্রাচীন সংস্কৃতিতে খুঁজে পাওয়া গেছে। মেসোপটেমিয়া, মিশর, গ্রীস, রোম, চীন এবং ভারতের পাশাপাশি মেসোআমেরিকা এবং কেল্টিক আয়ারল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ডের এলাকাতেও অনুরূপ ভাবনা সহ একাধিক গল্প পাওয়া যায়। ভূতকে বাইবেলে ঠিক একইভাবে চিত্রিত করা হয়েছে যেমন তারা তার আগের সময়ের রোমান আখ্যানে ছিল। নিম্নলিখিত আলোচনায় এই বিষয়ে বিস্তারিত কিছু লেখার চেষ্টা করা হয়নি। উল্লেখিত সংস্কৃতিগুলোর প্রায় প্রতিটাতেই ভূতে বিশ্বাস নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে এবং আবার কোথাও কিছুই লেখা নেই। এই নিবন্ধর উদ্দেশ্য শুধুমাত্র পাঠকদের প্রাচীন বিশ্বে পরকালের মৌলিক ধারণা এবং ভূতে বিশ্বাস বিষয়ে একটা ধারণা প্রদান করা।

মেসোপটেমিয়ায় ভূত

ভূতেদের এই পৃথিবীর মানুষদের কাছে আবির্ভূত হওয়ার অধিকার আছে কোনও ভুল দেখানোর জন্য বা কোনও ভুল সংশোধন করার জন্য।

মেসোপটেমিয়ার সংস্কৃতিতে, মৃত্যু ছিল জীবনের চূড়ান্ত সমাপ্তি যেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের কোনও পথ নেই। মৃতদের সেই দেশ নানান নামে পরিচিত ছিল; যার মধ্যে একটা ছিল ইরকাল্লা, পৃথিবীর নীচের রাজ্য যা ‘না ফেরার দেশ’ হিসাবে পরিচিত। যেখানে মৃতদের আত্মারা এক ভীষন অন্ধকারের ভিতর বাস করত, খাবার হিসেবে পেত ধুলোময়লা এবং কাদামেশা জলের গর্ত থেকে তৃষ্ণা নিবারন করতে হত (যদিও পরকালের অন্যান্য নিদর্শনও ছিল। যার কথা পাওয়া গেছে গিলগামেশ, এনকিডু অ্যান্ড দ্য নেদারওয়ার্ল্ড এর আখ্যানে)।

এই বিশেষ অস্তিত্ব ছিল সমস্ত জীবিতদের জন্য চূড়ান্ত পরিণতি, সে তারা যতই বড়মাপের ধনী বা অতি দরিদ্রর জীবন যাপন করুক না কেন। ওই স্থান শাসন করতেন অন্ধকারের রাণী ইরেশকিগাল। কোনও আত্মাকে কোনও কারণেই ইরকাল্লা ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হত না। এমনকি সে যদি কোনও দেব-দেবী হয় তবুও না। যেমনটা আমরা দেখতে পাই ‘দ্য ডিসেন্ট অফ ইনান্না’ কবিতায়। যেখানে এমনকি স্বর্গের রানী (এবং এরেশকিগালের বোন), ইনান্নাকেও তার জায়গা নেওয়ার জন্য একটা বিকল্প কাউকে খুঁজে বের করতে হয়েছিল। যাতে সে জীবিতদের জগতে ফিরে যেতে পারে। তবে, আত্মাদের বিশেষ সুযোগও দেওয়া হত, যদি বোঝা যেত ওই আত্মার কোন এক ধরণের অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করার প্রয়োজন আছে। ভূতেদের এই পৃথিবীর মানুষদের কাছে আবির্ভূত হওয়ার অধিকার আছে কোনও ভুল দেখানোর জন্য বা কোনও ভুল সংশোধন করার জন্য।

Queen of the Night or Burney's Relief, Mesopotamia
কুইন অফ দ্যা নাইট (বা বার্নিজ) রিলিফ, মেসোপটেমিয়া
Osama Shukir Muhammed Amin (Copyright)

তাদের এই উপস্থিতিগুলো সাধারণত জীবিত মানুষদের মধ্যে একধরণের অসুস্থ বিক্ষিপ্ততার জন্ম দিত। পণ্ডিত রবার্ট ডি. বিগস লিখেছেন:

মৃত - বিশেষ করে মৃত আত্মীয় - জীবিতদেরও সমস্যায় ফেলতে পারে, অন্তত সেই ক্ষেত্রে যেখানে মৃতদের কিছু দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পারিবারিক বাধ্যবাধকতায় তা অবহেলা করা হয়। বিশেষ করে জীবিতদের জীবনে ফিরে এসে সমস্যার সৃষ্টি করত এমনসব ব্যক্তিদের ভূত যারা স্বাভাবিক ভাবে মারা যায়নি বা যাদেরকে সঠিকভাবে কবর দেওয়া হয়নি - উদাহরণস্বরূপ, জলে ডুবে মৃত্যু বা যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু। (৪)

মেসোপটেমিয়ার চিকিত্সকরা, আসু এবং আসিপু নামে পরিচিত ছিল। তারা ভূত তাড়ানোর জন্য মন্ত্র ব্যবহার করতেন কিন্তু তার সাথেই, এই ধরনের চিকিত্সা শুরু করার আগে, চিকিত্সক রোগীকে অনুরোধ জানাত, সততার সাথে স্বীকার করতে বলত এমন কোনও গোপন পাপকাজের কথা যা পাতাল জগত থেকে ভূতকে উঠিয়ে আনতে পারে। মেসোপটেমিয়ায় শারীরিক অসুস্থতাকে কোনও পাপের বাহ্যিক প্রকাশ হিসাবে বিবেচনা করা হত। মনে করা হত, হয় এর কারণ দেবতাদের ক্রোধ বা বিদেহী আত্মাদের সূত্রে প্রাপ্ত শাস্তি। অন্য কোনোভাবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সর্বদা সব কিছু অসুস্থ ব্যক্তির দোষ বলে ধরে নেওয়া হত।

একজনের মৃত্যুর পরে, ‘গিদিম’ নামে পরিচিত এক আধ্যাত্মিক সত্তা তৈরি হতো। যা মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিগত পরিচয় বজায় রেখে এবং মৃতদের দেশে চলে যেত। যদি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং কবরস্থ করার দিকটায় যথাযথ মনোযোগ না দেওয়া হত বা যদি ব্যক্তির মৃত্যুর সাথে কিছু বেআইনী ব্যাপার জড়িয়ে থাকত, তাহলে এই গিদিমই জীবিতদের তাড়না করার জন্য ফিরে আসত। শিলালিপিগুলো থেকে এটাও জানা যায়, কখনও কখনও গিদিমরা দুষ্টুমি করে ইরকাল্লা থেকে পৃথিবীতে পালিয়ে আসতে পারত। কোনও উপযুক্ত কারণ ছাড়াই শুধুমাত্র জীবিতদের হয়রানি করার জন্য।

এই ধরণের আত্মাগুলোকে সূর্য দেবতা শামাশ শাস্তি দিতেন এক বিশেষ পদ্ধতিতে। ওই আত্মাদের জন্য নিবেদিত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নৈবেদ্য কেড়ে নিয়ে সেগুলো সেই সমস্ত গিদিমদের দিয়ে দিতেন, যাদের পৃথিবীতে স্মরণ করার মতো কেউ থাকত না। এর কারণে দুষ্টু আত্মাদের অস্তিত্ব অব্যাহত থাকাটাই সমস্যার হয়ে যেত, কারণ তাদের খাবার দেওয়ার মতো কেউ থাকত না। তবে এরকম প্রমাণও আছে প্রিয়জনদের সতর্ক করার জন্য বা উপদেশ দেওয়ার জন্য কিছু আত্মা জীবিতদের জগতে ফিরে এসেছে। বলাই বাহুল্য মেসোপটেমিয়ার বেশিরভাগ ‘ভূত’ ছিল অবাঞ্ছিত অতিথি। যাদেরকে তাদের নিজ জগতে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হত কবজ, তাবিজ, প্রার্থনা বা ‘এক্সরসিজম’ পদ্ধতি ব্যবহার করার মাধ্যমে।

মিশরীয় ভূত

ভূত দ্বারা নিগৃহীত হওয়া জীবিতদের কোনও এক যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতিতে ফিরে আসা আত্মাদের সাথে সরাসরি কথা বলে সমস্যা মিটিয়ে নিতে হবে।

প্রাচীন মিশরে, ভূতের প্রত্যাবর্তন এক অত্যন্ত গুরুতর বিষয় হিসাবে বিবেচিত হত। মিশরীয়দের জন্য, অস্তিত্বহীনতা ছিল একটি অসহনীয় ধারণা, এবং বিশ্বাস করা হত যে, মৃত্যুর পর, আত্মা ‘হল অফ ট্রুথ’এর দিকে যাত্রা করে। যেখানে ওসাইরিস এবং ৪২ জন বিচারক তার হৃদয়কে সাদা পালকের বিপরীতে রেখে বিচার করেন। যদি হৃদয় পালকের চেয়ে হালকা পাওয়া যায়, তবে আত্মা পরকালের জীবনের দিকে এগিয়ে যায়, এবং যদি ভারী হয় তাহলে ওটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। অপেক্ষমাণ এক দৈত্য সেই হৃদয় খেয়ে নেয়। যার ফলে আত্মাটার অস্তিত্বর বিনাশ ঘটে।

সেই মানুষের হৃদয় হালকা হবে যদি সেই হৃদয়ের অধিকারী জীবিত অবস্থায় ভালোভাবে জীবনযাপন করে থাকে। আর সেটা না করলেই হৃদয়ের ওজন ভারী হয়ে যায়। পরকালের এই জীবন ‘ফিল্ড অফ রিডস’ নামে পরিচিত ছিল, যা মিশরে পৃথিবীতে একজনের জীবনের একই রকম প্রতিরূপ বা প্রতিচ্ছবি। যেখানে আগের জগতের মতোই তার বাড়ির পরিবেশ উপভোগ করা যাবে। সেখানে তার বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাবে একই নদী, থাকবে তার প্রিয় গাছ এবং কুকুর। ফলে কোনও আত্মার পৃথিবীতে ফিরে আসতে চাওয়ার কোন কারণই থাকে না। যদি না সেই আত্মার কাছে এরকম কিছু করার বিশেষ কোনও কারণ না থাকে।

Egyptian God Osiris
ইজিপ্টের দেবতা ওসাইরিস
A.K. (Copyright)

মিশরের সূচনা লগ্নের যুগে, আত্মাকে ‘খু’ নামে পরিচিত এক একক সত্তা হিসাবে বিবেচনা করা হত। যা ছিল একজন ব্যক্তির অমরত্বের দিক ছিল কিন্তু পরবর্তী সময়ে, আত্মাকে পাঁচটা ভিন্ন উপাদান নিয়ে গঠিত বলে মনে করা হতে থাকে। এই উপাদানগুলোর মধ্যে দুটো, ‘বা’ এবং ‘কা’ (আত্মা এবং ব্যক্তিত্ব), মৃত্যুর পরে ‘আখ’ আকারে একত্রিত হয় এবং এই উপাদানটাই ভূত হয়ে ফিরে আসে। যদি কবর দেওয়ার সময় যথাযথ আচার পালন না করা হয়, বা ব্যক্তির মৃত্যুর আগে বা পরে জীবিতদের দ্বারা কিছু পাপ সংঘটিত হয়ে থাকে, তাহলে ‘আখ’ দেবতাদের কাছ থেকে অনুমতি পায় ভুলের প্রতিকার করার জন্য পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার।

ভূত দ্বারা নিগৃহীত হওয়া জীবিতদের কোনও এক যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতিতে ফিরে আসা আত্মাদের সাথে সরাসরি কথা বলে সমস্যা মিটিয়ে নিতে হবে। যদি তাতে কাজ না হয়, তাহলে একজন পুরোহিতকে দরকার এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য, যিনি জীবিত এবং মৃতর মধ্যে বিচারকের দায়িত্ব পালন করবেন। এর একটা উদাহরণ হিসাবে বলা যায় এই কাহিনি। যখন একজন স্ত্রীহীনার উপর দুর্ভাগ্য নেমে আসে, তখন প্রথমে সেটাকে কোনও ‘পাপ’ এর জন্য বলেই ধরে নেওয়া হয়, যা সে তার স্ত্রীর কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল। এখন সেই স্ত্রী ‘ফিল্ড অফ রিডস’ এ যাওয়ার পর জানতে পেরে শাস্তি দিচ্ছে। নতুন সাম্রাজ্যের সময়কালের এক সমাধিতে পাওয়া গেছে এরকম একজন স্ত্রী-হীনার লেখা চিঠি। যেখানে সে তার মৃতা স্ত্রীর কাছে লিখেছে। তার আত্মাকে অনুরোধ করেছে সে যেন তাকে মুক্তি দেয়। কারণ কোনও অন্যায় কাজ জ্ঞানত সে করেনি।

আমি তোমার সাথে কী এমন মন্দ কাজ করেছি যে, আমাকে এই খারাপ সময় সহ্য করতে হচ্ছে? আমি তোমার কি করেছি? কিন্তু তুমি আমার সাথে কি করলে, আমার দিকে আঙুল তুললে যদিও আমি তোমাকে লুকিয়ে খারাপ কিছু করিনি। আমি তোমার স্বামী হিসাবে তোমার সাথে বসবাস করার সময় থেকে আজ পর্যন্ত, কি এমন করেছি, যা তোমার কাছে লুকানো দরকার? অসুখে তুমি যখন অসুস্থ হয়ে পড়লে, আমি একজন ওস্তাদ-চিকিৎসককে আনিয়েছিলাম... আমি প্রকৃত একজন মানুষের মতো আট মাস কিছু না খেয়ে কাটিয়েছি। আমি আমার বাড়ির সামনে পৌঁছে নানান জিনিসপত্র দেখে খুব কেঁদেছিলাম। আমি তোমাকে আবৃত করার জন্য লিনেন কাপড় দিয়েছিলাম এবং তোমার জন্য শেষকৃত্যে যা যা কাজ করার ছিল, কিছুই বাদ রাখিনি। আর এখন, এটাও দেখ, আমি তিন বছর কোনও ঘরে না ঢুকেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছি, যদিও আমার মতো একজনের এটা করা ঠিক নয়। এটা আমি তোমার জন্য করেছি। কিন্তু, দেখ, তুমি এসবের ভালো মন্দ কিছুই বোঝো না। (নারদো, ৩২)

যদি সঠিকভাবে আচারপদ্ধতি পালন করে মৃত ব্যক্তির শরীরকে সমাহিত করা হয় এবং নিয়মিতভাবে তাদের স্মরণ করা হয়, তাহলে মৃতদের আত্মা জীবিতদের জন্য উপকারী সত্তা রূপে প্রতিভাত হয়, যারা সারা জীবন তাদের উপর নজর রাখেন। তবে, মিশরীয়দের ভাবনা অনুসারে একটা ‘আত্মা’ হলো সেই যে শান্তির সাথে ‘ফিল্ড অফ রিডস’য়েতে বসবাস করে। আর ‘ভূত’ তাকেই বলে, যে পৃথিবীতে ফিরে আসে।

গ্রীস এবং রোমে ভূত

প্রাচীন রোমে ভূতেরা নির্দিষ্ট পূর্ব অনুমানযোগ্য পদ্ধতিতে এবং সাধারণত, রাতের নির্দিষ্ট সময়েই আবির্ভূত হত এটা বোঝা যায়।

প্রাচীন গ্রীসে, পরকাল তিনটে স্বতন্ত্র এলাকা নিয়ে গঠিত ছিল। কেউ মারা গেলে, স্টিক্স নদীর ওপারে আত্মা নিয়ে যাওয়ার জন্য নৌকাচালক চ্যারন/ক্যারণকে অর্থ/মুদ্রা প্রদান করতে হত। এই মুদ্রা দেওয়া আত্মা এবং দেবতাদের মধ্যে শ্রদ্ধার চিহ্ন হিসাবে বেশি প্রচলিত ছিল, ‘মূল্য প্রদান’ ছিল না – তবে মুদ্রার মূল্য যত বেশি হতো, চ্যারনের নৌকায় আত্মা তত বেশি ভাল আসন পেত বসার জন্য।

একবার আত্মা অন্য দিকে পৌঁছে গেলে, তিন মাথাওয়ালা কুকুর সারবেরাসের পাশ কাটিয়ে যেতে হত এবং তারপরে তিন বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন আত্মা জীবিত অবস্থায় যে জীবনযাপন করেছিল তার হিসাব দিতে হয়। জীবনকালের গল্প বলা হয়ে গেলে বিচারকরা আত্মাকে লেথে নদী থেকে এক কাপ জল প্রদান করে। এ জল বিস্মৃতির জল, যা খেলে আত্মা পৃথিবীতে তার আগের জীবন ভুলে যাবে।

বিচারকরা এরপর আত্মার থাকার জন্য একটা জায়গা নির্ধারণ করে দেবেন: আপনি যদি একজন যোদ্ধা হন, যিনি যুদ্ধে মারা গেছেন, তাহলে আপনার স্থান হবে এলিসিয়ান ফিল্ডে। যা আসলে স্বর্গ। আপনি যদি একজন ভাল মানুষ হন, তাহলে আপনাকে পাঠানো হবে অ্যাসফোডেলের সমভূমিতে। সেই স্থানও মনোরম। আর আপনি যদি একজন খারাপ মানুষ হন, তাহলে আপনাকে পাঠান হবে টারটারাসের অন্ধকারে। যেখানে আত্মাকে তার জীবনকালে করা পাপের প্রায়শ্চিত্ত না হওয়া পর্যন্ত থাকতে হয়। কোনও আত্মাকেই ‘অনন্তকাল অভিশাপ’ ভোগ করতে দেওয়া হয় না। টারটারাসে থাকা আত্মা যথাসময়ে অ্যাসফোডেলের সমভূমিতে উন্নীত হতে পারে। মেসোপটেমিয়া এবং মিশরের সংস্কৃতির মতো, কোনও কারণেই আত্মাদের পৃথিবীতে ফিরে আসাটা গ্রীসেও প্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু কখনও কখনও সে ঘটনা ঘটত। এই একই মৌলিক ভাবনা রোমান সংস্কৃতিতেও গৃহীত হয়েছিল যারা গ্রীকদের তুলনায় ভূতের প্রতি অনেক বেশি গভীর বিশ্বাস পোষণ করত।

Attic Lekythos
অ্যাাটিক লেকিথস
Peter Roan (CC BY-NC)

কমেডি ‘মোস্টেলারিয়া’ (দ্য হন্টেড হাউস) এতে, রোমান নাট্যকার প্লাউটাস একটা গল্প বলেছেন। যেখানে কীভাবে থিওপ্রোপাইডেস নামে একজন ধনী এথেনিয়ান বণিক ব্যবসার কারণে দূরে চলে যায় এবং তার বাড়ির সব কাজের দায়িত্ব দিয়ে যায় তার ছেলে ফিলোলাচেসের উপর। ফিলোলাচেস তার বাবার অনুপস্থিতিকে একজন দায়িত্বশীল ছেলে হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করার পরিবর্তে জীবনকে পূর্ণ উপভোগ করার সুযোগ হিসেবে দেখে। সে এক ক্রীতদাসীকে ভালবাসত। তাকে স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য প্রচুর অর্থ ধার করে। এছাড়াও পৈত্রিক বাসভবনে তার বন্ধুদের জন্য এক জবরদস্ত ভোজসভার আয়োজন করে আরও বেশি অর্থ ব্যয় করে।

ফিলোলাচের জীবন এভাবেই কেটে যাচ্ছিল যতক্ষণ না তার দাস, ট্রানিও তাকে বলে যে, সে এইমাত্র জানতে পেরেছে অপ্রত্যাশিতভাবে থিওপ্রোপাইডেস তার ভ্রমণ থেকে ফিরে আসছেন এবং শীঘ্রই বাড়িতে এসে যাবেন। ফিলোলাচেস আতঙ্কিত হয়ে পরে, তার বাড়িতে থাকা অতিথি এবার কী হবে বা কীভাবে সে তার বিশাল ব্যয়ের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করবে বুঝে উঠতে পারে না। তবে ট্রানিও তাকে আশ্বাস দেয় যে, সব ঠিক হয়ে যাবে। ফিলোলাচেস এবং তার অতিথিদের বাড়িতে তালাবদ্ধ করে রেখে সে বাড়ির বাইরে থিওপ্রোপাইডেসের সাথে দেখা করে। জানায় থিওপ্রোপাইডেস এখন বাড়িতে প্রবেশ করতে পারবেন না। কারণ বাড়িটা ভূতের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। থিওপ্রোপাইডেসকে সেই দাস বলে, রাতের শেষ প্রহরে, যখন মশাল গুলো তখন তার আলো ছড়াচ্ছিল তখন একটা ভূত স্বপ্নে ফিলোলাচের সাথে দেখা করে। তাকে জানায়, সোনার লোভে একদা এই বাড়ির মালিক তাকে হত্যা করেছিল। ট্রানিও আরও বলে যে, খুন হওয়া ব্যক্তির মৃতদেহ এখনও এই বাড়িতেই লুকানো রয়েছে এবং কারও পক্ষে এর ভিতর প্রবেশ করা বিপজ্জনক।

থিওপ্রোপাইডস এখন কোথায় থাকবেন এ নিয়ে না ভেবে এবং হতাশ না হয়ে গল্পটা বিশ্বাস করে নেন। এই সময় এক অর্থ-ঋণদাতার আগমন হয়, যার কাছে থেকে ফিলোলাচেস ক্রীতদাসীর স্বাধীনতা কেনার জন্য ঋণ নিয়েছিল। সে তার অর্থ ফেরত চায়। ট্রানিও বলে, ওই অর্থ ফিলোলাচেস নিয়েছিল থিওপ্রোপাইডেসের বর্তমান বসবাসের অযোগ্য পুরানো বাড়ির পাশের বাড়িটা কেনার জন্য। থিওপ্রোপাইডেস পাশের বাড়িতে যান এবং সে বাড়ির মালিক সিমোর সাথে কথা বলেন। সিমোর সোজাসুজি জানিয়ে দেন যে, তিনি এই বাড়ি ফিলোলাচেসের কাছে বিক্রি করেননি। একথা শুনেও থিওপ্রোপাইডেস ভূতের গল্পে সন্দেহ করার কোনও লক্ষণ দেখাননি।

মৃতদের অনুপযুক্ত কবর - বা কোন কবরের অভাব – ইত্যাদিকে পরকাল থেকে আত্মার প্রত্যাবর্তনের প্রধান কারণ হিসাবে বিবেচ্য ছিল।

প্রাচীন রোমে ভূতেরা নির্দিষ্ট পূর্ব অনুমানযোগ্য পদ্ধতিতে এবং সাধারণত, রাতের নির্দিষ্ট সময়েই আবির্ভূত হত এটা বোঝা যায়। ইতিহাসবিদ ডি. ফেলটন উল্লেখ করেছেন যে, শ্রোতারা যারা মোস্টেলারিয়া উপভোগ করেছেন তারা ট্রানিওর অগোছালো অদ্ভুত ভূতের গল্পকে হাস্যকর মনে করতেন। কারণ ওটা এমন এক ভুতুড়ে ঘটনা যার অবস্থান সত্যি থেকে অনেক দূরে, আর শ্রোতারা এটা বুঝতেও পারত। খুন হওয়া ব্যক্তির ভূতকে অবশ্যই একটা মশালে আলোকিত ঘর বা স্থানে উপস্থিত হতেই হবে। (কমপক্ষে কোনও এক ধরনের আলো থাকতেই হবে, তাছাড়া ভূত দেখা যেত না) আর কোনও ভূত নিজের বন্ধু বা প্রিয়জন না হলে স্বপ্নে দেখা দেয় না।

স্বপ্নে আবির্ভূত ভূতগুলোকে সাধারণ ‘অস্থির’ প্রকৃতির, যাদের অসময়ে বা অন্যায় ভাবে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে এবং যথাযথ আচারপ্রথার সাথে সমাধিস্থ হয়নি, ভূতের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের আত্মা হিসাবে বিবেচনা করা হত। তাড়াহুড়োয় বাড়ির মালিকের জন্য এই দু ধরণের ভূতের গল্পকে একত্রিত করতে গিয়ে ট্রানিও এক বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। ফেলটন তার গবেষণায় লক্ষ্য করেন, প্রাচীন দর্শকরা এই বিভ্রান্তিটাকেই মজার মনে করতেন।

এই সুত্রে আরও একটা আকর্ষণীয় ভূতুড়ে গল্প হল তরুণী ফিলিনিয়নের গল্প। যা বলেছেন ট্র্যালেসের ফ্লেগন (২য় শতাব্দী) এবং পরে প্রোক্লাস (৫ম শতাব্দী)। যেখানে ফিলিনিয়নের বিয়ে হয় আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের একজন জেনারেল ক্রেটারাসের সাথে। বিয়ের ছয় মাস পর সে মারা যায়। কিন্তু সে আবার বেঁচে উঠে। প্রতি রাতে নিজের বাড়িতে নিজের ঘরে ম্যাচেটস নামে এক যুবকের সাথে দেখা করে। এই ব্যাপারটা যখন তার বাবা-মা জানতে পারেন তখন ফিলিনিয়ন জানায়, এক নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের কারণে ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল এবং দ্বিতীয়বার তার মৃত্যুও হয়।

নানান ইতিহাসবিদদের ভিতর একজন কেলি ই. শ্যানন, ইঙ্গিত করেছেন সেই দিকটায় যার মাধ্যমে ফ্লেগন তার গল্পকে বাস্তব প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। গল্পটাকে উনি পেশ করেছেন চিঠির আকারে কোনও এক মানুষের অভিজ্ঞতা রূপে। সাথেই এক নির্দিষ্ট সময় (ম্যাসিডনের ২য় ফিলিপ এর রাজত্বকালে) এবং নির্দিষ্ট স্থানে (অ্যাম্ফিপোলিস)র কথা উল্লেখ করে আখ্যানকে উনি এক ঐতিহাসিক সময়ের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। তার সাথেই সেই সতর্কতাও অবলম্বন করেছেন যাতে খুব বেশি কিছু নির্দিষ্ট করা না হয়। বলা যায় না তা হয়তো সেই স্থান এবং সময়ের ইতিহাসের সাথে পরিচিত একজন পাঠকের সন্দেহ করার কারণ তৈরি করবে। শ্যানন লিখেছেন:

যুক্তিসঙ্গতভাবে একজন পাঠক কী বিশ্বাস করবেন বলে আশা করা যায়? রোমান সাহিত্য সেন্টর থেকে শুরু করে ভূতের আবির্ভাব হয়ে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের দৃশ্যর মতো অদ্ভুত এবং অবর্ণনীয় প্রাণী, বস্তু এবং ঘটনা দিয়ে পূর্ণ। আর সেসব শুধু মিথের জগতে সীমাবদ্ধ নয়। প্রাকৃতিক জগতের বিবরণগুলো প্রায়শই এমন ঘটনার বিষয়ে ইঙ্গিত করে যা অলৌকিক বা অসম্ভব বলে মনে হতেই পারে: প্লিনি দ্য এল্ডারের মতো লেখকরা বাস্তব সত্যকেও এমনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন, যা কোনও যুক্তিবাদী আধুনিক শ্রোতা বা পাঠকের গুরুত্ব সহকারে নেওয়াই কঠিন, এমনকি অসম্ভব বলে মনে হবে। (১)

শ্যানন যে ধরণের ঘটনার কথা বলেছেন রোমানদের কাছে তা ‘মিরাবিলিয়া’ (আশ্চর্য বা অলৌকিক ঘটনা) হিসাবে পরিচিত ছিল এবং এতে কথা বলা প্রাণী, অবিশ্বাস্যভাবে লম্বা আত্মা রূপ নারী, দেবতাদের দর্শন এবং ভূত অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই ধরনের মিরাবিলিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল প্লিনি দ্য ইয়ংগার (৬১-১১৫ খ্রিস্টাব্দ) এর গল্প যিনি দার্শনিক এথেনোডোরাসের গল্প বলেছেন। যিনি এথেন্সে আসেন এবং একটা ভুতুড়ে বাড়ির কথা শোনেন যা সস্তায় ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, ওই বাড়িতে ভূত আছে বলে সবাই ভয় পাচ্ছে। এথেনোডোরাস বাড়িটা ভাড়া নেন এবং সেই রাতে, শিকলের শব্দ শুনে জেগে ওঠে নিজের ঘরে একজন লোককে দেখতে পান। যে তাকে উঠে তার সাথে আসতে ইশারা করছে। এথেনোডোরাস ভূতকে অনুসরণ করে বাড়ির উঠানের একটা জায়গায় যেতেই ভুতটা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়।

পরের দিন এথেনোডোরাস শহরের ম্যাজিস্ট্রেটকে সাথে নিয়ে সেই জায়গাটা খনন করান। যেখান থেকে তারা শিকল দিয়ে বাঁধা এক ব্যক্তির দেহাবশেষ খুঁজে পান। যথাযথ আচার প্রথা পালন করে দেহাবশেষ টাকে কবরস্থ করা হয়, এবং বাড়িটায় আর ভূতের আবির্ভাব হয়নি। এই গল্পটা একটা আদর্শ ‘ভুতুড়ে’ গল্পর উদাহরণ। যেখানে একটা আত্মা কোনও এক ভুলের প্রতিকার চায় বলে মনে হয়। মৃতদের অনুপযুক্ত কবর - বা কোন কবরের অভাব – ইত্যাদিকে পরকাল থেকে আত্মার প্রত্যাবর্তনের প্রধান কারণ হিসাবে বিবেচ্য ছিল। এমনকি মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আত্মার আকাঙ্ক্ষার চেয়ে আগের বিষয়কে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হতো।

প্রিয়জনের কাছে তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আত্মার ফিরে আসার সম্ভাবনার একটা গল্প বলেছেন অ্যাপুলিয়াস। যেখানে থ্র্যাসিলাস নামে একজন ব্যক্তি তার বন্ধু টলেপোলেমাসের স্ত্রীর প্রেমে পড়ে এবং শিকার করতে গিয়ে বন্ধুকে হত্যা করে। টলেপোলেমাসের আত্মা তার স্ত্রীর কাছে স্বপ্নে উপস্থিত হয়, তাকে জানায় সে কীভাবে মারা গেছে এবং তাকে এর প্রতিশোধ নিতে বলে। জানায়, সে ওই নারীর সাথে দেখা করে কথা বলতে চায়। কিন্তু বন্ধুর স্ত্রী দেখা করতে অস্বীকার করে, কারণ সে এখনও শোকপালন করছে। তারপরে জানায়, যাইহোক, রাতে দেখা করা যেতে পারে। রাতে দেখা করতে এলে তাকে ওই বিধবা নারী মাদকদ্রব্যযুক্ত মদ খেতে দেয়। নেশাচ্ছন্ন হয়ে থ্র্যাসিলাস ভুলুন্ঠিত হওয়ার পর চুলের কাঁটা দিয়ে ওই নারী তার চোখ নষ্ট করে দেয়। বলে সে যা করেছে তার জন্য মৃত্যু খুব সহজ একটা শাস্তি। তাই বাকি জীবনটা থ্র্যাসিলাসকে এখন এ জগত না দেখেই কাটাতে হবে। তারপর সে তার স্বামীর সমাধিতে দৌড়ে চলে যায়, তার মৃত্যুর প্রতিশোধের গল্প বলে এবং স্বামীর তরবারি দিয়েই আত্মহত্যা করে। থ্র্যাসিলাসও চলে যায় টলেপোলেমাসের সমাধিস্থলে। সেখানেই অনাহারে তার মৃত্যু হয়।

অতএব, সেই সময়ে প্রাচীন শ্রোতাদের কাছে এই দুটোই প্রধান উপায় ছিল ভূতের বোধগম্য আবির্ভাব হওয়ার (যদিও ভূতের আবির্ভাবের এ দুটোই একমাত্র উপায় ছিল না)। হয় স্বপ্নে অথবা শারীরিক উপস্থিতি নিয়ে এবং সাধারণত তাদের মৃত্যুকে ঘিরে থাকত কিছু সমস্যা। এই একই দৃষ্টান্ত অন্যান্য নানান সংস্কৃতিতেও পরিলক্ষিত হয়।

চীন ও ভারতের ভূত

ঘোস্ট ফেস্টিভ্যালের সময়, লোকেরা মৃতদের সন্তুষ্ট করার জন্য এবং তাদের সম্মান করার জন্য খাবার এবং উপহার প্রদান করে এই আশায় যে, তারা তাদের নিজস্ব জগতে থাকবে এবং জীবিতদের কষ্ট দেবে না।

চীনা সংস্কৃতিতে একজন ব্যক্তির আত্মা যে ডুবে গিয়েছিল, একা মারা গিয়েছিল, যুদ্ধে মারা গিয়েছিল, বা অন্য কোনও মৃত্যুতে ভুগে মারা গিয়েছিল, যেখানে তাদের কবর দেওয়া হয়নি, সে সশরীরে আবির্ভূত হতে পারে। তাকে শুধুমাত্র রাতের বেলায় মশালের আলোতে দেখা যাবে। কোনও পূর্বপুরুষের আত্মা, যিনি কোনও কিছুর তথ্য বা কোনও বিষয়ে সতর্কতা দিতে ইচ্ছুক, তিনি স্বপ্নে উপস্থিত হবেন।

চীনা দার্শনিক মো টি (আনুঃ ৪৭০-৩৯১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)র মতে ভূতকে একটা বাস্তবতা হিসাবেই বিবেচনা করা দরকার। যিনি মন্ত্রী তু পো-এর ভূতের, পরকাল থেকে ফিরে আসা এবং ঝোউ-এর রাজা জুয়ানকে হত্যার কথন মেনে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন। উনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, যখন লোকেরা বলে যে, একটা অজানা নির্দিষ্ট যন্ত্র কারও সাথে যুক্ত না থেকেও কীভাবে কাজ করে বা নির্দিষ্ট কিছু মানুষ কীভাবে আচরণ করে বা এমন একটা দেশের কথা বলে যেখানে তারা কখনও যায়নি, তখন তাদের প্রতিবেদন বিশ্বাসযোগ্য মনে হলে তা গ্রহণ করা উচিত, যদি তাদেরকে নির্ভরযোগ্য সাক্ষী বলে মনে যায়।

যুক্তির এই ধারাকে অনুসরণ করলে, ভূত সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তাও গ্রহণ করা উচিত। যদি সেই সব কথা এমন কোনও মানুষ বলে, যাদের জীবনের অন্যান্য জিনিস সম্পর্কে বলা কথা বিশ্বাস করা যায়, এবং একবারের জন্য হলেও সে সব কথা কেউ সত্যি হিসাবে যাচাই করে দেখেছে। যদি প্রাচীন ঐতিহাসিক বিবরণ এবং সেইসাথে কথকের বলা সময়ের সমসাময়িক প্রতিবেদনগুলোতে ভূতের উল্লেখ পাওয়া যায়, তাহলে সেগুলোকে বাস্তব হিসাবে গ্রহণ করা উচিত। যেভাবে কোনও একজনের কথার সূত্রে প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস এবং সেই দিনের সংবাদসূত্রের প্রতিবেদনগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাতে সেই ব্যক্তির একবারও ভূত দেখার অনুভূতি না থাকলেও কিছু যায় আসবে না।

ভূতের প্রতি চীনাদের বিশ্বাস তাদের পূর্বপুরুষ পূজার অনুশীলন দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। তারা বিশ্বাস করে যে, প্রয়াত ব্যক্তিরা মানুষের জীবনে এক শক্তিশালী প্রভাব ফেলে। উল্লিখিত অন্যান্য সংস্কৃতির মতো, মৃতদের আত্মা জীবিতদের উপকার করতে পারে যদি না কবর দেওয়া বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আচার-অনুষ্ঠানে কোনও অযৌক্তিক ভুলচুক হয়ে থাকে। মৃতদেরকে সু্যোগ দেওয়া হয় স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে ফিরে এসে হয়ে থাকা ভুলকে ঠিক করার।

‘ঘোস্ট ফেস্টিভ্যাল’ বা ভূত উত্সব, যা মৃতদের সম্মান ও তুষ্ট করার জন্য উদ্ভূত হয়েছিল, বছরের সপ্তম মাসের পনেরতম দিনে অনুষ্ঠিত হয়। ‘ভূতের মাস’ হিসাবে পরিচিত, এই সময়টায় মনে করা হয় জীবিত ও মৃতের রাজ্যের মধ্যকার বাধার পর্দা সবচেয়ে পাতলা হয়ে যায় এবং মৃতরা সহজেই সে দেওয়াল অতিক্রম করতে পারে (সামহেনের কেল্টিক ধারণার অনুরূপ এবং মেসোআমেরিকান ‘দ্য ডে অফ দ্য ডেড’ উত্সব এর মতোই)। ঘোস্ট ফেস্টিভ্যালের সময়, লোকেরা মৃতদের সন্তুষ্ট করার জন্য এবং তাদের সম্মান করার জন্য খাবার এবং উপহার প্রদান করে এই আশায় যে, তারা তাদের নিজস্ব জগতে থাকবে এবং জীবিতদের কষ্ট দেবে না।

Ghost Festival, China
ভূত উতসব, চীন
Mister Bijou (CC BY-NC-ND)

চীনাদের পরকালকে এমন এক যাত্রা হিসাবে ভাবা হয়েছে, যেখানে আত্মাকে এক অতল গহ্বরের উপর স্থিত এক সেতু অতিক্রম করতে হয়। যে সময় তার বিচার করা হয়। যদি আত্মা যোগ্য হয় তাহলে তার যাত্রা অব্যাহত থাকে। শেষবারের মতো জীবিতদের দেশটার দিকে ফিরে তাকানোর জন্য এক বিশেষ স্থানে থানার সুযোগ পায়। তারপরে মেংপো স্যুপ নামের তরল এক কাপ পান করে, যার ফলে সে তার আগের জীবনকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে যায়। চীনের ভূত সংস্কৃতি এই জায়গায় এসে আত্মার এরপর কী হবে তা নিয়ে একমত হতে পারে না। কিছু বিশ্বাস অনুসারে , আত্মা স্বর্গে চলে যায়, আবার অন্যদের মতে, তার পুনর্জন্ম হয়। যদি আত্মা পরকালের সেতু অতিক্রম করার সময় অযোগ্য রূপে বিবেচিত হয়, তাহলে তার পতন হয় নরকে। উভয় ক্ষেত্রেই, আত্মার জীবিতদের দেশে ফিরে আসার প্রত্যাশা কেউ করে না। যদি কেউ ফিরেও আসে এবং স্বপ্নে দেখা দেয় সে কোনোমতেই স্বপ্ন দেখা মানুষের পূর্বপুরুষ হতে পারে না। নিশ্চিতভাবেই এর সাথে কোনও ধরণের অশুভ শক্তি জড়িত থাকে।

১৬৮০ খ্রিস্টাব্দের লেখক পু সংলিং-এর গল্পের বই থেকে নিং কাইচেং এবং নি জিয়াওকিয়ানের গল্পে এর উদাহরণ পাওয়া যায়। গল্পটাকে ১৭ শতকের সময়কালের থেকে অনেক পুরনো বলে মনে করা হয়। যেখানে এক মন্দিরে নিং-এর পরিদর্শনের গল্প বলা হয়। ওই মন্দিরে তাকে নিয়ে গিয়েছিল যুবতী নিয়ের ভূত। ভূতটা নিংকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে, কিন্তু সৎ আচরণের প্রতি বিশ্বাসের কারণে নিং এই চাহিদাকে প্রতিরোধ করে। মন্দিরে ভ্রমণ করতে আসা অন্য দুই তীর্থযাত্রীকে পরের দিন সকালে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। যাদের পায়ের তলায় দেখা গেল কিছু ছিদ্র করা হয়েছে এবং তাদের শরীরের সব রক্ত শূন্য হয়ে গেছে। যুবতী ​​নি সম্মান জানায় নিংয়ের চারিত্রিক গুণকে। জানায়, মাত্র ১৮ বছর বয়সে সে এই মন্দিরেই মারা গিয়েছিল। যখন তার বয়স ছিল। তারপর সে এক দানবের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। যার অবস্থান ছিল ঠিক সেখানে যেখানে তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল। এই দানবটারর জন্যই সে ভ্রমণকারীদের প্ররোচিত প্রলুব্ধ করে। তারপর রক্ত ​​নিষ্কাশন করে ওই দানবকে খাওয়ায়। নিং যুবতী নিয়ের দেহাবশেষ মাটি খুঁড়ে উঠিয়ে সাথে করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। বাড়ির কাছেই একস্থানে সেসব পুনরায় সমাহিত করে এবং সম্মানের সাথে যাবতীয় আচার পালন করে। উপযুক্ত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার পর, যখন সে কবর ছেড়ে চলে যেতে উদ্যত হয় তখন আবার নিয়ের ডাক শুনতে পায়। তাকিয়ে দেখতে পায় তার সৎ আচরণ এবং দেহাবশেষ সঠিকভাবে কবর দেওয়ার কারণে নি পুনরায় জীবিত হয়ে উঠেছে। নিং এবং নি এরপর বিয়ে করে এবং গল্প অনুসারে সময়ের সাথে সাথে তারা তাদের সন্তানদের সাথে সুখে শান্তিতে বসবাস করে।

চীনের ভূতের গল্পগুলো প্রায়শই এই ‘লিজেন্ড অফ নিং এবং নি’-এর মতো নৈতিকতাকেই প্রধান করে দেখায় এবং অন্যদের প্রতি সৎ আচরণ এবং দয়া প্রদর্শনের উপর জোর দেয়। কনফুসিয়াস নিজেও ভূতের গল্পের কার্যকারিতায় বিশ্বাস করতেন। কারণ তিনি অনুভব করেছিলেন অতিপ্রাকৃত সাক্ষাত থেকে শেখা পাঠগুলি জীবিতদের মধ্যে যথাযথ গুণাবলী স্থাপন করতে পারে। তিনি অনুভব করেছিলেন যে, এই বিষয়টা তথাকথিত ‘ক্ষুধার্ত/বিশেষ চাহিদাযুক্ত ভূত’দের, সেই সব আত্মারা যাদের আত্মীয়রা তাদের শ্রদ্ধা এবং স্মরণের দায়িত্ব ভুলে গিয়েছে, সাথে মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রেও যতটা সঠিক, আবার যাদের হত্যা করা হয়েছিল কিন্তু তাদের হত্যাকারীদের কোনও বিচারের আওতায় আনা যায়নি তাদের আত্মাদের ক্ষেত্রেও একই রকম। এরকম ক্ষুধার্ত ভূতরা তাদের প্রাপ্য না পাওয়া পর্যন্ত জীবিতদের যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য দেবতাদের কাছ থেকে বিশেষ সুযোগ পায় বলে মনে করা হতো। এই ধরণের ভূতেরা জীবিতদের বাড়িতেই বসবাস করতে সক্ষম এবং চেনাজানা ‘পোল্টাগাইস্ট’য়ের মতো আচরণ করত।

ভারতের ক্ষেত্রেও এই ভাবনা একই রকম। যেখানে মৃত মানুষের ভূতকে এক ধরণের ‘ক্ষুধার্ত ভূত’ হিসাবেই দেখা হয়। প্রাচীন (এবং আধুনিক) ভারতে মৃত মানুষের আত্মা ‘ভূত’ নামে পরিচিত এবং মানুষের রূপেই তারা আবির্ভূত হয়। তবে পায়ের পাতা উল্টো দিকে থাকে। যারা কোনও কিছু বোঝার আগেই নিজেদের চেহারা পরিবর্তন করতে পারে। মনে করা হয় যে, কিছু একটা ভুল হয়ে গেছে, আত্মা অপ্রাকৃত অবস্থায় অবস্থান করছে এরই প্রতীক হিসাবে পা পিছনের দিকে প্রদর্শিত হয়। ভূত রূপ সত্তা তখনই বাস্তবায়িত হয় যখন কোনও ব্যক্তি পৃথিবীতে তাদের নির্ধারিত সময়ের আগে মারা যায়। যেহেতু তারা তাদের জীবনের পূর্ণতা উপভোগ করতে অক্ষম হয়েছে, তাই তারা কোন জীবিত ব্যক্তির দেহের অধিকারী হওয়ার আশায় পৃথিবীতে ফিরে আসে।

ভূতে ধরা, যার মধ্যে আত্মা তাদের নিজের মৃতদেহকে পুনরায় সজীব করে তোলে, প্রাচীন ভারতে এক বড়মাপের উদ্বেগের বিষয় ছিল। কিছু গবেষক পণ্ডিত মনে করেন যে, এর থেকেই মৃতদের দাহ করার প্রথা চালু হয়েছিল। যদি একটা মৃতদেহকে দাহ করা হয়, তবে আত্মা কিছুতেই সেটাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ফিরে আসতে পারবে না। এরপর কিছু বিশেষ বস্তু পোড়ানোর সাথে তাবিজ এবং প্রার্থনার ব্যবস্থা করলে, নিজের মৃতদেহে পুনরায় বসবাস করার সুযোগ নেই এটা বুঝে মৃত ব্যক্তির আত্মা জীবিত মানুষকে আর নিজেদের দখলেও নিতে পারে না।

কারণ এমন অনেক ভূতুড়ে অঞ্চল, বাড়ি এবং এমনকি শহরের গল্প শোনা যায় যেখানে বহু শতাব্দী ধরে ভূত রয়েছে।

যেহেতু এই আত্মারা তাদের নির্ধারিত সময়ের আগেই মারা গেছে, তাই তারা অসন্তুষ্ট এবং সাধারণত রেগেই থাকে। ভূতরা যখন নিজেদেরকে শারীরিকভাবে প্রকাশ করে তখন তারা একাধিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করা হয়। কিন্তু, অন্যান্য সংস্কৃতির মতোই, যখন তারা স্বপ্নে আবির্ভূত হয় তখন তারা উপকারী বলে বিবেচিত হয় এবং স্বপ্নদ্রষ্টার পরিচিত কারোর আত্মা হিসেবেই তাকে পাওয়া যায়, বিশেষ করে সে তার একজন আত্মীয় এটাই ঘটে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।

ভারতে এক বিশেষ বিপজ্জনক ভুত ‘চুড়েল’ নামে পরিচিত, যার সৃষ্টি হয় সেই নারীর আত্মার সূত্রে যে, প্রসবকালীন সময় মারা গিয়েছে। এই ভূত রাস্তার মোড়ে আবির্ভূত হয় বলেই বিশ্বাস এবং জীবিতদের সাথে বিশেষ ধরণের বন্ধুত্ব করতে চায়। যদি জীবিত ব্যক্তি একজন নারী হয় তবে চুড়েল তার সন্তানদের চুরি করতে বা তার দেহ দখল করার চেষ্টা করে। আর যদি একজন পুরুষ হয় তবে তাকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করবে এবং সফল হলে তাকে হত্যা করে। পৃথিবীতে তার বরাদ্দ সময় শেষ হয়ে গেলে একটা ভূত, এমনকি চুড়েলও, নিজে থেকেই সব কিছু ছেড়ে চলে যাবে এবং পুনর্জন্মের বহমান স্রোতে আবার প্রবেশ করবে।

পরকাল বিষয়ক ভারতীয় বিশ্বাস নির্দেশ করে যে, মৃত ব্যক্তির আত্মার পরবর্তীকালে কী পরিণতি হবে সেটা জীবিত সময়ে দেহে থাকাকালীন অবস্থায় তার ক্রিয়াকলাপ অনুসারে বিচার করা হয়। এর সূত্রেই হয় আধ্যাত্মিক শ্রেণিবিন্যাস, যা আত্মাটাকে আগের জীবনে চেয়ে উচ্চ বা নীচের স্তরে জন্ম নেওয়ার সুযোগ পায় চলে যায়। তবে এটাও মনে হয়, সব আত্মাই পরবর্তী জীবনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। কারণ এমন অনেক ভূতুড়ে অঞ্চল, বাড়ি এবং এমনকি শহরের গল্প শোনা যায় যেখানে বহু শতাব্দী ধরে ভূত রয়েছে।

এইসব স্থানের ভিতর অন্যতম বিখ্যাত হল রাজস্থানের ভানগড় ফোর্ট। যা এক পরিত্যক্ত দুর্গশহর। মনে করা হয় ওটা ভূতের আবাসস্থল। শহরের নির্মাণ হয়েছিল ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে এবং কিংবদন্তি অনুসারে, কাছেই আস্তানা গেড়ে বসা এক একাকী সন্ন্যাসীর দ্বারা অভিশাপগ্রস্থ না হওয়া পর্যন্ত এ এক সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। গল্পের এক সংস্করণে, এই সন্ন্যাসী একজন জ্ঞানী ব্যক্তি যিনি এক বিশেষ শর্তে এই শহরকে তার আশীর্বাদ প্রদান করেছিলেন। সেই শর্ত এই যে, শহরে এমন কোনও উচ্চতার বাড়ি বানানো যাবে না, যা সূর্যর আলো আটকাবে এবং তার আস্তানায় ছায়া ফেলবে। শহরের মূল নির্মাতারা তার এই চাহিদাকে সম্মান করেছিলেন কিন্তু, পরে, এই শর্ত মানুষ ভুলে যায়। এমন প্রাসাদ বানানো হয় যা সন্ন্যাসীর আস্তানার উপর তার ছায়া ফেলে। উনি শহর এবং এর বাসিন্দাদের এই বিবেচনাহীন কাজের জন্য অভিশাপ দেন। এক রাতের ভিতর শহরের সমস্ত বাড়ির উপরের তলাগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। যারা বেঁচে ছিল তারা ভানগড় দুর্গ পরিত্যাগ করে এবং কাছেই ভানগড় নামেই নতুন শহর তৈরি করে।

Bhangarh Fort Ruins, Rajasthan
ভানগড় দুর্গের ধ্বংসাবশেষ, রাজস্থান
Parth Joshi (CC BY-NC-SA)

আর একটা গল্পে, সুন্দরী রাজকন্যা রত্নাভি এবং দুষ্ট জাদুকর বাবা বালনাথের কথা পাওয়া যায়। জাদুকর রাজকন্যার প্রেমে পড়েছিল কিন্তু জানত যে, সে কখনই তার ভালোবাসা মেনে নেবে না। এক বিশেষ প্রেমের তরল বানায় জাদুকর, যা রাজকন্যাকে তার দিকে শক্তি সহযোগে আকৃষ্ট করবে। তরলটাকে সুগন্ধির বোতলে ঢেলে জাদুকর একদিন বাজারে ওটা রাজকন্যাকে উপহার দেয়। রত্নাভি সন্দেহ করেছিল যে, বোতলটাতে সুগন্ধির বদলে নিশ্চিত অন্য কিছু আছে। সে বোতলের তরল কাছের একটা বড় পাথরের উপর ঢেলে দেয়। তরলের জাদুকরী ক্ষমতার কারণে, পাথরের টুকরোটা সরাসরি জাদুকরের দিকে ধেয়ে যায় এবং তাকে থেঁতলে দেয়।

মরতে মরতে বাবা বালনাথ এক ভয়ঙ্কর অভিশাপ দেন রত্নাভি এবং সমগ্র শহরকে। শপথ নিয়ে বলেন এখানে ​ কেউ আর কখনও ছাদের নিচে বসবাস করতে পারবে না। গল্পের আগের সংস্করণের মতোই, শহরে কিছু একটা বিপর্যয় ঘটে এবং এক রাতের ভিতর নির্জন হয়ে যায়। বালনাথের অভিশাপ সত্যি হয়, ওই স্থান আর কখনও জীবিতদের বসবাসের যোগ্য থাকেনি। তবে মৃতরা এখনও ভানগড় ফোর্টে বসবাস করে বলে মনে করা হয় এবং বর্তমান সময়ে শোনা যায় তাদের ভুতুড়ে কণ্ঠস্বর, পুরানো স্নানাগার থেকে ভেসে বিচ্ছিন্ন হাসির শব্দ, পদধ্বনি। অনেকে শহরে আলো জ্বলতে দেখেছেন বলে দাবি করেছেন। এমনকি রাজকন্যা রত্নাভির আত্মাকেও নাকি তারা দেখেছেন।

মেসোআমেরিকান ভূত

মায়াদের বিশ্বাস অনুসারে, দীর্ঘস্থায়ী ভূত যেমনটা বানগড়ের বাসিন্দা ভূতেরা অত্যন্ত মাত্রার অসহনীয় সত্তা। এদের মন্ত্র এবং তাবিজের মাধ্যমে দূরে রাখা দরকার বা একজন ডে-কিপার (শ্যামন) বা ওঝার এর মধ্যস্থতার মাধ্যমে পাতালে ফেরত পাঠানো দরকার। পরকাল বিষয়ে মায়াদের ধারণাটা মেসোপটেমিয়ার দৃষ্টিভঙ্গির অনুরূপ। পাতালজগত এক অন্ধকার এবং ভয়ানক জায়গা। কিন্তু মায়ারা সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও কিছুটা বিস্তারিত করেছিল: মায়া পাতাল জগতে (জিবালবা বা মেটানাল নামে পরিচিত) মৃতদের অসংখ্য নিয়ন্ত্রা আছে, যারা মৃতের আত্মাকে স্বর্গে যাওয়ার পথে প্রতারণা করতে পারে।

আত্মা একবার এই পাতালজগতে নেমে গেলে, এমন এক যাত্রা পথের অংশ হয়ে যায় যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না। ভূতেরা, উল্লিখিত অন্যান্য সংস্কৃতির মতোই, পার্থিব রাজ্যে ফিরে আসবে বলে মনে করা হয় না। আত্মা শরীর ছেড়ে বের হয়ে যাওয়ার পর এক আত্মারূপ কুকুরের সাহায্য পাবে, বিশাল জলময় এক স্থান এবং বিভিন্ন এলাকা পার হয়ে যাওয়ার জন্য। এখানেই জিবালবার নিয়ন্ত্রারা ফাঁদ পেতে বসে থাকে। সঠিক পথ দেখিয়ে ওই কুকুর সাহায্য করে জীবন বৃক্ষের কাছে পৌঁছতে। যে বৃক্ষে আরোহণ করে আত্মা স্বর্গে পৌঁছে যেতে পারে।

মায়াদের মতই, অ্যাজটেকরা মনে করত যে পরকাল হল এক বিষণ্ণতার স্থান যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না।

তাই যাদের আত্মা ফিরে আসে, তারা অপ্রাকৃতিক বলে বিবেচনা করা হত। যদি না, অন্যান্য সংস্কৃতির মতো, তারা স্বপ্নে আবির্ভূত হয় এবং বন্ধু বা পরিবারের সদস্য হিসাবে স্বীকৃত হয় (যদিও এটা সর্বদা প্রযোজ্য হয় না)। মায়ারা বিশ্বাস করতে পছন্দ করে যে, যে সমস্ত মৃতরা প্রকালে সঠিকভাবে বিশ্রাম নিতে পারে না, তারা গাছের আকারে ফিরে আসতে পারে। সে গাছ হয় উপকারী আর তা না হলে তাকে এড়িয়ে যাওয়াই উচিত।

এই বিশ্বাসের সর্বোত্তম উদাহরণ হল ‘লিজেন্ড অফ দ্য এক্সটাবে’র কাহিনী। যা দুই সুন্দরী নারী, এক্সকেবান এবং উটজ-কোলেলের গল্প বলে। নগরের সম্মানিত লোকেরা এক্সকেবানের সাথে খারাপ আচরণ করেছিল কারণ সে বিবাহিত হয়েও অন্য একজন পুরুষের সাথে বেআইনি যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু কোমল হৃদয় এই নারীকে তার ভালো আচরণের জন্য এবং সবার প্রতি তার দয়া প্রদর্শনের কারণে নিম্ন শ্রেণীর মানুষেরা খুব ভালবাসত। উটজ-কোলেলকে উচ্চ শ্রেণীর মানুষেরা খুব সম্মান করত। কারণ তার জন্ম হয়েছিল এক ভালো পরিবারে এবং সে সমস্ত সামাজিক শিষ্টাচার পালন করত। কিন্তু এই নারী ছিল কঠোর হৃদয় এবং নিষ্ঠুর। নিজেকে ছাড়া অন্য কারোর দিকে তার নজর ছিল না।

একদিন, এক অদ্ভুত এবং নেশা জাগানো সুগন্ধে গ্রাম ছেয়ে গেল। কোথা থেকে এই সুগন্ধ আসছে তার উৎস খুঁজতে গিয়ে দরিদ্র মানুষেরা পৌঁছে গেল এক্সকেবানের কুঁড়েঘরে। দেখতে পেল কোনও এক অজানা কারণে ঘরের ভিতরে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে মেয়েটা। তার শরীর থেকেই ওই সুন্দর গন্ধ বের হচ্ছিল। লোকেরা তাকে কবর দেয় এবং পরের দিন দেখা যায় তার কবর জুড়ে সুন্দর বুনো ফুলের গাছ জন্মেছে। যা থেকে আগের দিনের মতোই একইরকম সুগন্ধ ছড়াচ্ছে।

এর কিছুদিন বাদে, উটজ-কোলেল মারা যায়। কিন্তু তার শরীর থেকে ভয়ানক দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। গ্রামের নামীদামী লোকেরা তাকে একজন ভালো ও মহীয়সী নারী হিসেবে দারুণ রকম আচারপ্রথা পালন করে বড় এক সমাধিতে কবরস্থ করে এবং সেখানে অনেক ফুলের চারা রোপণ করে। কিন্তু পরের দিনই গাছগুলো মরে যায়। তার কবর থেকে তজ্যাকাম নামে পরিচিত এক ফুলগাছ জন্মায়। যার কোন ঘ্রাণ নেই ওদিকে এক্সকেবানের কবরে জন্মেছিল যার মিষ্টি গন্ধর এক্সটাবেন্টান নামের ফুলগাছ। দুই নারীর আত্মা তাদের নিজ নিজ ফুলগাছের সাথে মিশে যায়।

যখন উটজ-কোলেল দেখতে পায় যে, সে সুগন্ধবিহীন এক কাঁটাযুক্ত ফুল, তখন সে এক্সকেবানের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে এবং বিশ্বাস করে এক্সকেবানের শারীরিক প্রেমের পাপই ওকে এরকম সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে। সে জিবালবার অন্ধকারস্থিত আত্মা নিয়ন্ত্রকদের সাথে হাত মেলায় যাতে তারা তাকে আবার জীবিত করতে পারে। যাতে সে যারতার সাথে খুশি মতো যৌন সম্পর্ক তৈরি করে এক্সকেবানের মতো আশীর্বাদ পেতে পারে। উটজ-কোলেল বুঝতেই পারেনি, এক্সকেবানের আশীর্বাদ প্রাপ্তির কারণ প্রেম। আর তার ভিতর শুধুই উচ্চাকাঙ্ক্ষার অবস্থান। উটজ-কোলেল পৃথিবীতে ফিরে আসে এক্সটাবে ফুল রূপে তজ্যাকাম ক্যাকটাস গাছে জন্মায়। তবে মাঝে মাঝে মেয়েমানুষের রূপ ধারণ করতে পারে। রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করে ভ্রমণকারীদের জন্য। যদি কোনও পুরুষ তার প্রতি মনোযোগ দেয়, তবে সে তাকে প্রলুব্ধ করে এবং তারপর তাকে হত্যা করে। আর যদি যদি ভ্রমণকারী একজন মহিলা হয়, সে তার মানসিক শান্তি নষ্ট করে তাকে শাস্তি দেয়।

Tezcatlipoca Turquoise Skull
নীলকান্ত মণির তেজকাতলিপকা করোটি
Trustees of the British Museum (Copyright)

অ্যাজটেকদের ভূত বিশ্বাসের জগতে ভারতের চুড়েলের অনুরূপ এক সত্তা রয়েছে। অ্যাজটেকদের এই আত্মা সিহুয়াতেটিও নামে পরিচিত এবং অব্যসী এক নারীর ভূত যার প্রসবের সময় মৃত্যু হয়েছে। এই আত্মারাও তাদের বিচরণের এলাকা হিসাবে রাস্তা মোড়কেই বেছে নেয়। তবে পুরুষদের উপেক্ষা করে; অপেক্ষা করে বাচ্চা সমেত নারীদের জন্য। এরকম নারীদের আঘাত করে এবং সাথে থাকা বাচ্চা নিয়ে পালায়। রাতের বেলায় শিশুদের অপহরণ করার জন্য এরা বাড়ির ভিতরেও ঢুকে যেতে পারে বলে মনে করা হয়।

সিহুয়াতেটিও থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দরজা এবং জানালায় তাবিজ এবং কবচ ঝুলিয়ে রেখে দেওয়া হয়। অ্যাজটেক বিশ্বাস অনুসারে, ভূতেরা সবসময় অবাঞ্ছিত অতিথি। যারা কেবল খারাপ খবর নিয়ে আসে বা ধ্বংসের লক্ষণ হিসাবে প্রতিভাত হয়। মায়াদের মতই, অ্যাজটেকরা মনে করত যে পরকাল হল এক বিষণ্ণতার স্থান যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না। ফলে যখন কোনও আত্মা ফিরে আসে, সেটা আসলে এক স্পষ্ট ইঙ্গিত কিছু একটা ভুল হয়েছে বা শীঘ্রই হবে।

Mictlantecuhtli, God of Death
মিক্লান্তেকুতলি, মৃত্যুর দেবতা
Dennis Jarvis (CC BY-SA)

মায়া এবং তারাস্কানদের মতো, অ্যাজটেকরা বিশ্বাস করত যে, কুকুররা দেখতে পারে এবং ভূতের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারে। আর এই জন্যই এরা মৃতর সাথে কুকুরকে কবর দিত। মনে করত, ওরা পাতালজগতে পথপ্রদর্শক হিসাবে এবং পরবর্তী জীবনে আত্মার রক্ষকের কাজ করবে। তারাসকানরা ভূতের ভয় নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন থাকত এবং তার জন্যই ‘স্পিরিট ডগ’য়ের ধারণাটা তৈরি করেছিল। মনে করা হত যে, ভূত হল তাদের আত্মা যাদেরকে ভুলভাবে কবর দেওয়া হয়েছিল বা যারা একাকী শিকারে মারা গিয়েছিল বা যারা জলে ডুবে মারা গিয়েছিল এবং তাদের দেহ কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই আত্মারা জীবিতদের তাড়না করতে ফিরে আসবে, যতক্ষণ না তাদের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায় এবং যথাযথভাবে আনুষ্ঠানিকতার সাথে সমাহিত করা হয়। সমস্যা, অবশ্যই, যে মৃতদেহ সব সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। এই ক্ষেত্রে, তারাসকানরা মনে করেছিল যে একটা ‘আত্মা কুকুর’ দেহটা খুঁজে বের করবে এবং আত্মাকে পরকালের দিকে নিয়ে যাবে যাতে ওটা আর জীবিতদের কষ্ট না দেয়।

মৃতদের জন্য শোক করার পরিবর্তে মেসোআমেরিকান সংস্কৃতিতে তা আনন্দের সাথে উদযাপন করা হত। যা বর্তমান সময়ের ‘দ্য ডে’ অফ দ্য ডেড’ (এল ডিয়া ডে লস মুয়ের্তস) নামে পরিচিত অনুষ্ঠানের জন্ম দিয়েছে। ওই সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই দিনে একত্রিত হয় যারা অন্য জগতে চলে গেছে তাদের স্মরণ করা এবং তাদের জীবনযাত্রা উদযাপন করার জন্য। অ্যাজটেকরা মূলত, এই উৎসবের সময় পাতালজগতের দেবী মিক্টেক্যাসিহুয়াটলকে সম্মান জানাত। তারপরে মারা যাওয়া শিশুদের আত্মাকে সম্মান জানাত এবং পরলোকের জগতে চলে যাওয়া প্রাপ্তবয়স্কদের সম্মান প্রদর্শন করত। সূচনায় উত্সবটা ভুট্টা কাটার সময় (জুলাইয়ের শেষ থেকে আগস্ট পর্যন্ত) অনুষ্ঠিত হত। কিন্তু স্প্যানিশদের আক্রমণ ও বিজয়ের পর ক্যাথলিক চার্চের অল সেন্টস দিবসের সাথে তাল মিলিয়ে এটি নভেম্বরে স্থানান্তরিত হয়।

কেল্টিক ভূত

মেসোআমেরিকাতে ‘ডে অফ দ্য ডেড’এর মরসুমের এই পরিবর্তন এসেছে ক্যাথলিক চার্চের পূর্বে বিদ্যমান পৌত্তলিক উত্সবগুলোকে ‘খ্রিস্টান সম্মত’ করার নীতির কারণে। উত্তর ইউরোপে আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং ওয়েলসে অনুরূপ উদযাপন দেখা যায়, যা ‘Samhain’ (উচ্চারণ সউ-হেন বা সো-হোয়েন) নামে পরিচিত। এইসব অঞ্চলের পৌত্তলিক ধর্ম পালন কারীরা জীবনকে রৈখিক নয় চক্রাকার রূপে হিসাবে দেখেছিল। যেমন বছর একটি চাকার মতোই ঘোরে। সউ-হেন ছিল একটা চক্রের শেষ এবং পরেরটার শুরু। মনে করা হত যে, এই সময়ে, জীবিত এবং মৃতের মধ্যে যে পর্দা আছে তা পাতলা হয়ে যায় এবং মৃতরা আবার জীবিতদের জগতে হাঁটা চলা করতে পারে।

অক্টোবরের শেষের দিকে/নভেম্বরের শুরুতে এর সময়কাল এবং ঐতিহ্যগতভাবে ৩১শে অক্টোবর সূর্যাস্তের সময় এর শুরু হয় এবং ২রা নভেম্বর পর্যন্ত চলে বলে মনে করা হয় (যদিও কেউ কেউ ৩১শে অক্টোবরের এক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু করে আর এক সপ্তাহ পরে এই উদযাপন চালিয়ে যান)। ইন্টারনেটের অনেক আধুনিক উত্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু জনপ্রিয় টেলিভিশন শো দাবি করে যে, সউ-হেন ছিলেন মৃতদের কেল্টিকদের মৃত্যু দেবতা এবং ৩১শে অক্টোবর তার উদ্দেশে বলি দেওয়া হয়। আসল ঘটনা মোটেই তা নয়। সউ-হেন নামে কেল্টিকদের কোনও মৃত্যুর দেবতা কখনও ছিল না। কেল্টিক ভাষায় ‘সউ-হেন’ এর অর্থ "গ্রীষ্মের শেষ"।

ফসল কাটার পর সউ-হেন এক গুরুত্বপূর্ণ উৎসব উদযাপন ছিল, গবাদি পশু জবাই করা হত এবং শীতের জন্য লবণ দিয়ে জারানো হত। হাড়গুলো পুড়িয়ে দেওয়া হত, এমন এক অভ্যাস যা থেকে বোন ফায়ার এর সূত্রপাত। যা আজ ‘বনফায়ার’ নামে পরিচিত।

মৃত ব্যক্তিরা এই সময়টাতে এ জগতে অবাধে চলাফেরা করবে বলে মনে করা হত এবং মানুষেরা সেই সব খাবার তৈরি করে যা তাদের বিদেহী বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়রা বেঁচে থাকতে উপভোগ করেছিল। ফসল কাটার পর সউ-হেন এক গুরুত্বপূর্ণ উৎসব উদযাপন ছিল, গবাদি পশু জবাই করা হত এবং শীতের জন্য লবণ দিয়ে জারানো হত। হাড়গুলো পুড়িয়ে দেওয়া হত, এমন এক অভ্যাস যা থেকে বোন ফায়ার এর সূত্রপাত। যা আজ ‘বনফায়ার’ নামে পরিচিত।

সউ-হেনের উৎসবের এক অন্ধকার দিক ছিল বা বলা ভাল নেতিবাচক দিক ছিল, এই সময় মৃতরা বেশ কিছুটা পরিমাণে অস্থির হয়ে উঠত (চীনের ক্ষুধার্ত ভূতেদের মতো)। সাথেই তারা এ জগতে বিচরণ করার ক্ষমতা পেত। এদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য ওই সম্প্রদায়ের মানুষেরা মুখোশ পরার অভ্যাস শুরু করেছিল। যাতে তাদেরকে কোনও আত্মা চিনতে না পারে। এই প্রথাই সময়ের সাথে সাথে আধুনিক দিনের হ্যালোইন উৎসব উদযাপনে বিকশিত হয়েছে।

খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দীর মধ্যেই কেল্টদের বেশিরভাগ অঞ্চল জয় করে নিয়েছিল রোমান সাম্রাজ্য। খ্রিস্টধর্ম যখন খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে সাম্রাজ্যের সরকারী ধর্ম হয়ে ওঠে, তখন গির্জা তাদের ক্যালেন্ডারে অনেক পৌত্তলিক ছুটির দিন অন্তর্ভুক্ত করে। যেহেতু সউ-হেন এক জনপ্রিয় উত্সব ছিল, তাই এটাকে গির্জা ‘অল হ্যালোজ’ বা ‘হ্যালোমাস’ হিসাবে জুড়ে দেয়। যা পরে’ অল সোলস ডে’ এবং তারপর যখন বিশ্বাসীরা মৃতদের আত্মা শুদ্ধির জন্য প্রার্থনা শুরু করে তখন এটা ‘অল সেন্টস ডে’ হয়ে ওঠে। ইউরোপে সউ-হেনের মতো, মেক্সিকোতে ‘ডে অফ দ্য ডেড’ এর ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছিল; পৌত্তলিক উত্সবগুলো বদলে যায় খ্রিস্টান উৎসব পালনের দিন রূপে।

উপসংহার

যদিও ‘অল সোলস ডে’-তে মৃতরা পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে এই বিশ্বাসটা বজায় ছিল, তবে পরবর্তী জীবনের খ্রিস্টীয় দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সাথে সাথে ভূত এবং শয়তানের সাথে এটা যুক্ত হয়ে যায়, এবং অনেক কিছু পরিবর্তিত হয়। বাইবেলে ভূতের উল্লেখ আছে নানা অনুচ্ছেদে, যেমন ম্যাথু ১৪:২৫-২৭, মার্ক ৬:৪৮-৫০, এবং লুক ২৪:৩৭:৩৯। ভূত সম্পর্কিত সবচেয়ে বিখ্যাত অনুচ্ছেদগুলোর মধ্যে একটা হল প্রথম স্যামুয়েল ২৮:৭-২০। যেখানে রাজা শৌল ‘উইচ অফ এন্ডোর’ এর কাছে যান এবং বলেন, তার প্রাক্তন উপদেষ্টা এবং ঈশ্বরের একজন অনুসারী স্যামুয়েলের ভূতকে জাদুর মাধ্যমে জাগ্রত করতে। ঈশ্বরের উপর নির্ভর করার পরিবর্তে এক আত্মার সাথে পরামর্শ করার জন্য শৌল ভবিষ্যতে ঈশ্বরের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হন।

ভূতেদের বিশেষ করে আত্মাকে জাদুর মাধ্যমে জাগ্রত করাকে নেতিবাচক রূপে দেখা, এই ব্যাপারটা খ্রিস্টধর্মকে জনপ্রিয় করেছিল, বেড়েছিল তার অনুগামী। মার্ক এর ৬ অনুচ্ছেদটাকে ভূতের এক নেতিবাচক উপস্থাপনা হিসাবেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। শিষ্যরা যীশুকে জলের উপর হাঁটতে দেখে মনে করে যে উনি একজন ভূত। কিন্তু ভূত জলের উপর হাঁটতে পারে না, শুধুমাত্র দেবতারা এবং যারা ঐশ্বরিক ক্ষমতা সম্পন্ন তারা পারে। তাই যখন শিষ্যরা যীশুকে ভূত বলে ভুল করে, তখন ধরে নেওয়া হয় যে, তারা যীশুর পরিত্রাণের বার্তা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে নিজেদের হৃদয়ের সাড়া নেই এটাই জানান দেয়। প্রদর্শন করে। গবেষক পণ্ডিত জেসন রবার্ট কম্বস উল্লেখ করেছেন যে, মার্কের লেখক যেভাবেই হোক বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার শ্রোতারা এই ঘটনাকে ভূতের প্রতীক হিসাবেই ধরে নেবে। উনি লেখেন:

ঈশ্বর এবং ঐশ্বরিক মানুষ জলের উপর হাঁটতে পারে; ভূত নয়। কিন্তু শিষ্যরা যখন যীশুকে জলের উপর দিয়ে হাঁটতে দেখে, তখন তারা বাস্তব নয় বরং অসম্ভবকে বিশ্বাস করে। মার্কের এই অযৌক্তিক যুক্তি পেশের সুত্র, "কারণ তারা তাকে সমুদ্রের উপর হাঁটতে দেখেছিল, তারা ভেবেছিল যে উনি একজন ভূত" (৬:৪৯), নাটকীয়ভাবে সে জোর দেয় শিষ্যদের মনে যীশুর ‘মেশিয়া সুলভ এক ভ্রান্ত ধারণা চাপিয়ে দেওয়ার। (৩৫৮)

মার্কের লেখক ক্রমাগত এই বিষয়টাই তুলে ধরেন যে, শিষ্যরা যীশু কে ছিলেন এবং তাঁর লক্ষ্য কী ছিল তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল। তার বইয়ের প্রথম দিকে ভূতের ব্যবহার তার প্রাচীন শ্রোতাদের কাছে এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিল যে একটা ভূত জলের উপর হাঁটতে পারে না এবং শুধু তাই নয়, ভূত তাড়াতে প্রায়শই জল ব্যবহার করা হত। বাইবেলের পুস্তক প্রথম জন ৪:১ বলে যে, একজনের সমস্ত আত্মাকে পরীক্ষা করা উচিত যে তারা ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে কিনা এবং কোনও আত্মাকেই শুধু দেখে বিশ্বাস করা উচিত নয়। এই অনুচ্ছেদটা, মার্ক এবং প্রথম স্যামুয়েল এবং অন্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত নানান অনুচ্ছেদে প্রকাশিত বিশ্বাসের সাথে মিলে যায়, যা ভূত সম্পর্কে মানুষকে পূর্বের তুলনায় আরও বেশি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালনপালন করার জন্য উৎসাহিত করেছে।

যদিও ভূতকে সবসময়ই অনাকাঙ্খিত এবং অপ্রাকৃতিক হিসাবেই বিবেচনা করা হয়ে আসছিল, এখন এদের শয়তানের সাথে যুক্ত করে দেওয়া হল এবং শয়তানের ‘এজেন্ট’ হিসাবে দেখানো শুরু হলো। মানুষকে ভূতের বাস্তবতাকে প্রত্যাখ্যান করতে উত্সাহিত করা শুরু হয়েছিল কারণ, মৃত্যুর পর, ব্যক্তির আত্মা স্বর্গ, নরক বা শুদ্ধিকরণে যায় এবং পৃথিবীতে ফিরে আসে না। যদি কেউ ভূত দেখেন, তাহলে ধরে নেওয়া উচিত যে সেটা শয়তানের একটা কৌশল ছিল, যাতে তারা ঈশ্বরের ঐশ্বরিক আদেশকে সন্দেহ করার দায়ে নরকের ফাঁদে পড়ে যায়।

ভূতের প্রতি এই মনোভাব শেক্সপিয়রের হ্যামলেট নাটকে নাটকীয় উদ্দেশ্যেই কাজে লাগানো হয়েছে। যখন প্রিন্স হ্যামলেট সন্দেহ করেন যে, তিনি যে ভূত দেখেছেন তা আসলে তার পিতা। যিনি মৃতদের মধ্য থেকে ফিরে এসেছেন, বলেন, "আমি যে আত্মাকে দেখেছি/সে শয়তান হতে পারে, এবং সেই শয়তানের ক্ষমতা আছে/এক পছন্দসই আকৃতি ধারণ করার, হ্যাঁ, এবং সম্ভবত/আমার দুর্বলতা এবং আমার বিষণ্ণতা থেকে/যেহেতু সে এই ধরনের মানসিকতা নিয়ে নাড়াচাড়া করে /তাই আমাকে উত্যক্ত করছে অভিশপ্ত করার জন্য " (২য় অঙ্ক, ২য় দৃশ্য, ৬১০-৬১৫)। ভূত সম্বন্ধে এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, ভূত আসলে যারা মারা গিয়েছে তাদের আত্মা এই পুরানো ধারণাটাকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দেয়। যেহেতু এরা শয়তানের অনুচর, তাই তাদের প্রতি বিশ্বাসকে নিরুৎসাহিত করা হতে থাকে।

সময়ের সাথে সাথে, বিশ্বকে দেখার এক ধর্মনিরপেক্ষ এবং আরও ‘বৈজ্ঞানিক’ উপায়ের প্রতি ক্রমবর্ধমান আস্থা গির্জার দ্বারা শুরু করা কাজটি সম্পূর্ণ করে এবং ভূতকে কুসংস্কার আর কল্পকাহিনীর রাজ্যে ছেড়ে দেয়। এই বিষয় নিয়ে কাজ করা নানান ওয়েবসাইট এবং বইয়ের সংখ্যা থেকে বিচার করলে, বলা যেতেই পারে আধুনিক দিনে অনেকেই আছেন যারা ভূতের বিষয়ে আগ্রহী কিন্তু সাধারণভাবে বলতে গেলে, এই বিশ্বাসকে সাংস্কৃতিকভাবে উৎসাহিত করা হয় না। বলাই যায়, প্রাচীন বিশ্বে ভূতকে যেভাবে দেখা এখন তার ঠিক বিপরীত পরিস্থিতি।

সাংবাদিক জন কিল, যিনি অনেক তথাকথিত অলৌকিক ঘটনা তদন্ত করেছিলেন এবং তার বই ‘দ্য মথম্যান প্রফেসিস’ এর জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত, একবার লিখেছিলেন যে, ‘অলৌকিক’ বা ‘অতিপ্রাকৃত’ বলে কিছু নেই। ইতিহাসের পাতা জুড়ে থাকা মানুষের অভিজ্ঞতা হয়েছে এমন বেশ কয়েকটা অদ্ভুত ঘটনা নাড়াচাড়া করার পরে, কেল এটাই অনুধাবন করেছেন যে, আধুনিক দিনের মানুষেরা যাকে ‘অলৌকিক’ বা ‘অতিপ্রাকৃত’ ঘটনা বলে তা আসলে পৃথিবীতে জীবনের স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক দিক।

কেলের মতে আত্মা, ভূত এবং অপ্রাকৃত সত্তার জগৎ যা কোনও এক পরকাল থেকে আবির্ভূত হতে পারে, হয়তো সেটা আজকের দিনে বাস্তবতার মতোই মনে হতে পারে যা প্রাচীন বিশ্বের মানুষের কাছে ছিল। মানুষ আর ভূতেদেরকে জীবনের একটা অংশ হিসাবে গ্রহণ করে না, কারণ একটা জীবিত জগত যেভাবে কাজ করে সেখানে ওই জগত বৈধ হিসাবে স্বীকৃত নয়। তার এক নতুন দৃষ্টান্ত রূপে খ্রিস্টধর্মের উত্থানের সাথে এ জগত বিশেষভাবে বদলে গিয়েছিল এবং মহাবিশ্বকে এক ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার গ্রহণযোগ্যতা ভূতেদের জীবিতদের রাজ্য থেকে আরও দূরে সরিয়ে দিতে শুরু করেছিল। শেষ পর্যন্ত, তারা তাদের প্রকৃত রূপ এবং শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং গল্প আর কিংবদন্তির প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠে।

বিজ্ঞাপন সরান
বিজ্ঞাপন

গ্রন্থ-পঁজী

ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি এনসাইক্লোপিডিয়া একটি অ্যামাজন সহযোগী এবং যোগ্য বই ক্রয়ের উপর একটি কমিশন উপার্জন করে।

অনুবাদক সম্পর্কে

Pratim Das
I am an Artist. My goal - paint all the Indian Sub-continental bird species. already done 1200+ species. Hobby is writing in Bengali [My mother tongue] and also like to do translation from English To Bengali. Some books published from India and Bangladesh.

লেখক সম্পর্কে

Joshua J. Mark
জোসুয়া যে মার্ক একজন 'ফ্রিল্যান্স' লেখক এবং নিউ ইয়র্ক, মারিস্ট কলেজের প্রাক্তণ পার্ট-টাইম প্রফেসর অফ ফিলজফি। নিবাস গ্রীস এবং জার্মানি। ইজিপ্ট ভ্রমণ করেছেন একাধিকবার। কলেজে উনি ইতিহাস, লেখালিখি, সাহিত্য এবং দর্শন বিষয়ে শিক্ষাদান করেছেন।

এই কাজটি উদ্ধৃত করুন

এপিএ স্টাইল

Mark, J. J. (2014, October 30). প্রাচীন বিশ্বে ভূতের ভাবনা [Ghosts in the Ancient World]. (P. Das, অনুবাদক). World History Encyclopedia. থেকে প্রাপ্ত https://www.worldhistory.org/trans/bn/1-13359/

শিকাগো স্টাইল

Mark, Joshua J.. "প্রাচীন বিশ্বে ভূতের ভাবনা." অনুবাদ করেছেন Pratim Das. World History Encyclopedia. সর্বশেষ পরিবর্তিত October 30, 2014. https://www.worldhistory.org/trans/bn/1-13359/.

এমএলএ স্টাইল

Mark, Joshua J.. "প্রাচীন বিশ্বে ভূতের ভাবনা." অনুবাদ করেছেন Pratim Das. World History Encyclopedia. World History Encyclopedia, 30 Oct 2014. ওয়েব. 03 May 2024.